|| প্রথম পর্ব || অনেকদিন পর সেদিন বিকেলে একটু হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম। পার্কের একটা বেঞ্চের উপর অনেকক্ষণ ধরে একটা ডায়েরি পড়েছিল। ডায়েরিটা খোলা। হাওয়াতে পাতাগুলো উল্টে পাল্টে যাচ্ছিল। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেলাম না। আমি কৌতূহলবশতঃ এগিয়ে গেলাম। কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে খুঁজতে লাগলাম কোনো তথ্য বা দরকারি কিছু লেখা আছে কি না... মাঝেমাঝে কিছু লেখা আছে। তার অর্থ যদিও বের করা যাচ্ছে না। প্রায় শেষের দিকে একটা পৃষ্ঠায় নাম ও ঠিকানা লেখা। প্রফেসার অভিষেক চৌধুরী, বাড়ি নং ১২০, রোড নং ১৩/ক, গড়িয়াহাট, কলকাতা। চমকে উঠলাম। তারপর এটা সেটা ভেবে, ডায়েরিটা রেখে, উঠে চলেই যাচ্ছিলাম... এমন সময় মনে হল, একবার এই ঠিকানায় খোঁজ নেওয়া দরকার। বিষয়টা জানতে হবে। ডায়েরিটা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আমাকে বারবার একটা জিনিস ভাবাচ্ছে। মানে আমি যেটা ভাবছি সেটা যদি হয়! আমার যাওয়াটা সত্যিই খুব দরকার। ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে গেল বুঝতে পারিনি। পরদিন সকালে গেলাম সেখানে। কলিংবেল বাজাতেই একটা বছর পঁচিশের ছেলে দরজা খুলে দিল। - কাকে চান? - প্রফেসার অভিষেক চৌধুরীর সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি বাড়িতে আছেন? - আপনি ওনাকে চেনেন? - হ্যাঁ। - কে আপনি? - দরজায় দাঁড়িয়েই বলবো নাকি ভিতরে এসে... - আসুন, ভিতরে আসুন। - তোমার নাম? - সুমন। - কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পুরোনাম বলতে হয়। যাইহোক, আমি অভিষেক স্যারের ছাত্র। যাও, স্যারকে ডাকো, আমি অপেক্ষা করছি। - আপনি বসুন, আমি ডাকছি। সুমন চলে গেল। ডায়েরিটা বার করলাম না। আমি বাড়িটা খেয়াল করতে লাগলাম। সবকিছু আগের মতোই টিপটপ, সাজানো গোছানো। কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে কোন একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে এই বাড়িতে। কাজের মেয়েটা চা দিয়ে গেল। সাথে বিস্কিট আর এক গ্লাস জল। আমি জল খেয়ে, চায়ে চুমুক দিতেই প্রায় বছর চল্লিশের এক সুন্দরী মহিলা এলেন। সাদা রঙের শাড়ি, চোখে চশমা। চুলটা কোনোরকমে আলগোছে বাঁধা। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলাম। - আপনি মিসেস চৌধুরী? - হ্যাঁ। আপনি কি আমাকে চেনেন? - না। - তাহলে আমার স্বামী কি আপনাকে চিনতেন? - চিনতেন মানে? তিনি কোথায়? আমি ওনার সাথেই দেখা করতে এসেছি। - আসলে পরশু রাতেই উনি মারা গেছেন। - ওহ মাই গড! কি করে ! - বলছি, কিন্তু তার আগে আপনার পরিচয়টা জানতে পারি? আপনাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি... - আমি মিহির বিশ্বাস। পেশায় একজন সাংবাদিক। আমি চৌধুরী স্যারের ছাত্র। কলেজ জীবনের। - হ্যাঁ, ঠিক। মনে পরেছে, আপনার ইনটারভিউ দেখেছি অনেক। আর্টিকল ও পড়ি মাঝে মধ্যে। - যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি? - নিশ্চয়, বলুন। - আচ্ছা, চৌধুরী স্যার কিভাবে মারা গেলেন? একটু থেমে উনি বললেন, - প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে হার্ট এটাক। কিন্তু আমার ধারণা ওনাকে খুন করা হয়েছে। - কে খুন করেছে? - এটা বলতে পারছি না। তবে আমার সুমনকে সন্দেহ হয়। - ওকে দেখে তো তেমনটা মনে হল না ও খুন করতে পারে। - মিহির বাবু আপনি কি এটা জানেন, এসব ব্যাপারে যাকে সবচেয়ে কম সন্দেহ করা হয়, শেষে দেখা যায় সেই আসল অপরাধী। - বাহ্ আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অবশ্য এদিক থেকে দেখলে তো আপনিই দোষী তা প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মিসেস চৌধুরী হাসলেন। বেশ শব্দ করেই হাসলেন। - আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে স্যারের মৃত্যুটা যতটা বেদনাদায়ক, তারচেয়ে বেশি রহস্যময়। - বেশ তো, রহস্য ফাঁস করতে চাইলে, করতেই পারেন। ভালোই তো। - আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করে এই রহস্য উদ্ঘাটনের কাজটা দেন, অবশ্যই চেষ্টা করবো আমি। এই সুযোগে মগজে একটু ধার দিয়ে নেওয়া যাবে। - বেশ, তাই হোক। আপনি চাইলে এখানে থেকেই কাজটা করতে পারেন। গেস্টরুমে থাকবেন। যাবতীয় বিষয়ে বাড়ির সবাই আপনাকে সাহায্য করবে। আমি সুমন আর রুমাকে ডেকে বলে দিচ্ছি। ওরা আপনাকে সব দেখিয়ে দেবে। মিসেস চৌধুরী সুমন আর রুমাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, শোনো, মিহির বাবু এখানে কিছুদিনের জন্য থাকবেন। উনি তোমাদের স্যারের ছাত্র, খুনের রহস্য বের করবেন। সুমন খুবই অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, কাকা খুন হয়েছেন? - সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে মিসেস চৌধুরী সেরকমটাই ধারনা করছেন। আচ্ছা, আপনি কি পুলিশকে আপনার ধারনার কথা জানিয়েছেন মিসেস চৌধুরী? - না। পুলিশ তাদের মত করে কাজ করুক। আর আপনি আপনার মতো। - তাও ঠিক। আমি আজ রাতেই চলে আসব। - রাত এগারোটার আগেই আসবেন। এগারোটার পর আমাদের বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যায়। মনটা বেশ ভারাক্রান্ত। কলেজ জীবনের পুরনো কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। মৃত্যুসংবাদ কখনো কাউকে সুখ দান করে না, একমাত্র খুনি ছাড়া। হালকা একটা টেনশন হচ্ছে। যদিও টেনশন করার কিছু নেই। কিন্তু অদ্ভুত লাগার মতো একটা বিষয় খেয়াল করলাম। মিসেস চৌধুরীর চোখে মুখে হতাশা বা শোকাহতের বিশেষ কোনো চিহ্ন নেই। একটু খটকা লাগলো। আর সেই কারণেই ওনাদের বাড়িতে থাকতে রাজিও হয়ে গেলাম, সবটা ভালোভাবে যাচাই করবো বলে। ডায়েরিটার কথা ইচ্ছা করেই আর বললাম না। আমি "চৌধুরী ভবন" থেকে বেরিয়ে সামনের একটা দোকান থেকে সিগারেট নিলাম। মনের ভারের সাথে সাথে টেনশন কমাতে নিকোটিন বেশ কার্যকরী। বাড়ি এসে একটা ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ও বইপত্র নিলাম। অফিসেও দু'দিনের ছুটি চেয়ে নিলাম। একটু কসরত করতে হলো বটে... দশটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম "চৌধুরী ভবন"। কাজের মেয়ে রুমা আমাকে থাকার জন্য গেস্টরুমে নিয়ে গেল। - স্যার, আপনি কি এখানে খাবেন নাকি ম্যাডামের সাথে ডাইনিংরুমে গিয়ে খাবেন? - তার আর দরকার নেই। আমি খেয়েই এসেছি। - ঠিক আছে আমি তাহলে আসি... - দাঁড়াও, তোমার সাথে একটু কথা বলি। রুমা কেমন যেন ভয় পেল। আমি সিগারেট ধরালাম। - আচ্ছা তুমি এই বাড়িতে কতদিন ধরে কাজ করছো? - তা প্রায় তিন বছর। - তোমার স্যার যেদিন মারা যান, তুমি কোথায় ছিলে? - বাড়িতেই ছিলাম। - এই বাড়িতেই তো খুন হয়েছে, নাকি? - হ্যাঁ স্যার। - তুমি কিভাবে জানলে খুন হয়েছে? সবাই তো বলছে যে উনি মারা গেছেন, হুম? - না স্যার। মানে ইয়ে... - খুন টা তুমি করোনি তো? - না না স্যার, কি বলছেন? আমি এসব করিনি। ভগবানের নাম করে বলছি। - আচ্ছাআচ্ছা, বুঝেছি। এবার বলো তো, সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, সব খুলে বল। - স্যার, আমি সারাদিন কাজকর্ম করি। তাই রাতে সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে, কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। ওইদিন সাহেব ওনার পড়ার ঘরে ছিলেন। সকালে মেঝেতে স্যারের মৃতদেহ পাওয়া যায়। - রাতে কোনওরকম শব্দ পাওনি? - না স্যার, আমি ঘুমোলে মরার মত ঘুমোই। - তোমার স্যারের মৃতদেহটা প্রথম কে দেখেছিল? - স্যারের পড়ার ঘরে আমাদের কারও ঢোকার অনুমতি নেই। আমরা কেউ যাই না। ম্যাডামই যেতেন। আর খুব দরকার হলে সুমন দাদা যায়। কিন্তু সেদিন ম্যাডামই গেছিলেন। উনিই প্রথম দেখেছিলেন। রুমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। তাকে বিদায় দিলাম। সিগারেটটা শেষ করে শুলাম। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম। ঘুম আসতে দেরী হচ্ছিল। বারান্দায় এলাম হাওয়া খেতে। রাত হয়ে আসছে বেশ। তেমন লোকজন নেই। গেটের বাইরে শুধু কয়েকটা ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখলাম..... || দ্বিতীয় পর্ব || পরদিন সকালে খাবার টেবিলে এলাম। মিসেস চৌধুরী, সুমন, রুমা সবাই আছে। আমি খেতে খেতে মিসেস চৌধুরীকে বললাম, - আপনার কি কোনো ব্যস্ততা আছে? - না, কেন বলুন তো? - ব্রেকফাস্ট শেষে আপনার সাথে কিছু কথা আছে। - বেশ। খাওয়া শেষ করে আমি বারান্দায় এসে বসলাম। সিগারেট ধরাতে যাবো তখনই মিসেস চৌধুরী এলেন। সিগারেট টা না জ্বালিয়েই রেখে দিলাম। মিসেস চৌধুরী আমার সামনের চেয়ারটাই বসে বললেন, - বলুন কী জানতে চান? - সকালে চা খেয়েছেন? - আমি চা খাই না। - কেন? - চা খেলে স্কিন কালো হয়ে যায়। - ওহ্। - হঠাৎ চায়ের প্রসঙ্গ? - আসলে চা টা খুব ভালো হয়েছিল, তাই। - তাহলে আরেক কাপ দিতে বলি? - না। থাক। দ্বিতীয় কোনো কিছুই প্রথমের মতো ভালো হয় না। মিসেস চৌধুরী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তিনি ধারনা করলেন, আমি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছি। তিনি যদি এটা ধারনা করে থাকেন, তাহলে ওনার ধারনা সঠিক। মিসেস চৌধুরী অভিষেক স্যারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী'র সাথে আমাদের আলাপ ছিল। ওনারা নিঃসন্তান ছিলেন। পরবর্তীতে শুনেছিলাম, স্যারের পত্নীবিয়োগের কথা। উনি আবার বিয়ে করেছেন তাও শুনেছিলাম। কিন্তু আলাপ করার সুযোগ হয়নি। আর সুযোগ টা যে এভাবে হবে তা আশা করিনি। আমি বললাম, - আপনাদের সন্তান নেই? - না। - কেন নেই- এই প্রশ্নটা অমূলক। তবে আমার ধারণা আপনাদের মধ্যে বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। স্যারের বয়স হয়েছিল সত্তর। আর আপনার চল্লিশের আশেপাশে। ঠিক বললাম? - হ্যাঁ। - চৌধুরী স্যারের প্রথম স্ত্রী কিভাবে মারা যান? - ক্যান্সারে মারা যান। - আচ্ছা, স্যারের মৃত্যুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কি আপনি দেখেছেন? - না। পুলিশ এখনো দেয়নি। - আচ্ছা, এটা বলুন, যে রাতে স্যার খুন হন তখন আপনি কোথায় ছিলেন? - আমি আমার ঘরে ছিলাম। ঘুমোচ্ছিলাম। - আপনি সাধারণত কখন ঘুমোন? - বারোটার আগেই ঘুমিয়ে যাই। - তাহলে গতরাতে এক'টার দিকে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেছিলেন কেন? মিসেস চৌধুরী ঢোঁক গিলে আমার দিকে তাকালেন। আমি একটু থেমে আবার বললাম, - আপনি নিয়মিত রাত জাগেন। আপনার চোখমুখ সে কথা বলে দিচ্ছে। আপনি মিথ্যে বলছেন কেন? - এমনিই। দেখলাম, আপনি বুঝতে পারেন কি না। একটু হেসে বললাম, - যাইহোক, সেই রাতের ঘটনা বলুন। ঠিক কি কি হয়েছিল? - উনি রাতে আমার সাথে খুব কমই থাকতেন। প্রায়ই লাইব্রেরিতে থাকতেন। মাঝেমধ্যে রাতে লাইব্রেরিতেই ঘুমোতেন। আমি আমার ঘরে ছিলাম। টিভি দেখছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। কখন ঘুমিয়ে যাই বুঝতে পারিনি। সকালে উঠে লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি ওনার ডেডবডি পড়ে আছে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। ওনারা এসে লাশ নিয়ে যান ময়নাতদন্তের জন্য। - আচ্ছা, ওনার বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে কে? উনি কি কোনো উইল করে গেছেন? - এটা আমি সঠিকভাবে বলতে পারবো না। তবে মনে হয় উনি কোনো উইল করেন নি। - আপনি সুমনকে সন্দেহ করছেন যে ও খুন করেছে। কিন্তু, আমি যতদূর জানি, আইন অনুযায়ী সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে সুমন। তাহলে সুমন কেন খুন করবে ওর কাকাকে? আর কিভাবে খুন করা হয়েছে বলে আপনার ধারণা? - সেটা তো বলতে পারবো না। সম্পূর্ণ টা আমার ধারণা। - শুধু ধারণার ওপর নির্ভর করে কিছু বলা যায় না মিসেস চৌধুরী। যাইহোক, আপনি রেস্ট নিন। অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। - কোন দরকার হলে ডাকবেন। মিসেস চৌধুরী চলে গেলেন। আমি থানায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম রিপোর্ট জানার জন্য। প্রথমে ফোন করে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জানতে চাইলে আমাকে কোনকিছু জানানো হলো না। আমি আমার বন্ধু এসপি তারককে ফোন করলাম। তারপর রিপোর্ট শুনে আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। এটা কী করে সম্ভব??? || অন্তিম পর্ব || কিছুক্ষণ পরে সুমনকে ডেকে পাঠালাম। - সুমন, এটা বল, তুমি এই বাড়িতে কতদিন ধরে আছো? তোমাকে আমার ছাত্রাবস্থায় তো দেখিনি... - তা প্রায় দশবছর। - তোমার বাবা মা কোথায়? - বাবা মা মারা গেছেন। তারপর থেকে আমি কাকার কাছেই থাকি। - সেই রাতে তুমি কোথায় ছিলে? - আমার ঘরে ছিলাম। - আমার ধারণা তুমি মিথ্যে বলছ। কারণ আমি "চৌধুরী ভবন" আসার পর গত রাতে বারোটার দিকে তোমাকে বাইরে দেখেছি। ওটা তুমিই ছিলে, আমি ভুল করছি না, কি তাই তো? সুমন ভ্যাবাচ্যাকা খেল। - না মানে, ইয়ে...... - আমতা আমতা করছো কেন? তুমি তো একজন ভালো ছাত্র ছিলে। কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছো। চাকরি না করে এখানে পড়ে আছো কেন? - আসলে কাকা একা ছিলেন। ওনার দেখাশোনা আমিই করি। ওনার নিজের বলতে আর কেউ নেই, ওনার সবকিছুই পরবর্তীতে আমার, তাই চাকরিবাকরি করার কথা মনে হয়নি। - বাহ্। কাকার ভরসায় সারাজীবন! যাইহোক, তোমাকে আমি বাইরে দেখলাম কিভাবে শুনবে? আমি দোতলার বারান্দা থেকে কাল রাতে দেখলাম কয়েকটা ছেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার চিনতে কষ্ট হয়নি, যে সেই দলে তুমিও ছিলে। - আসলে স্যার, আমি রাতে লুকিয়ে আমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাই। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াটা কাকা-কাকিমা পছন্দ করেন না, তাই... - নিশ্চয় মেইনগেট দিয়ে বের হও না? - না, বাড়ির পিছনে একটা ছোটো গেট আছে। ওটার চাবি আমার কাছে। - তোমাকে এই বাড়িতে দেখার আগে কোথায় যেন দেখেছি। কোথায় দেখেছি বলোতো? মনে করতে পারছি না। - আপনি আমাকে এখানেই প্রথম দেখেছেন। - না, ভুল বললে। এখানে এসে প্রথম কথা হয়েছে। আগে কোথায় যেন দেখেছি, কোথায়... হ্যাঁ মনে পড়েছে, তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম পার্কে। আমার ধারণা তুমিই পার্কে ডায়েরিটা ফেলে রেখেছিলে আমার জন্য, যাতে আমি স্যারের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে পারি। ঠিক? অনেকক্ষণ চুপ থেকে সুমন বলল, - হ্যাঁ। আমি আপনাকে আগে থেকেই চিনি। আপনার সাংবাদিকতা জগতে যথেষ্ট নাম ডাক আছে তা আমি জানি। আর এও জানি, আপনি কাকার একজন প্রিয় ছাত্র। বাকিদের থেকে আপনাকে কাকা বেশিই ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। আপনি যে খুব বুদ্ধিমান তাও আমার জানা। অনেকের অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন আপনি। কদিন ধরেই কাকা অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন। তাই আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম, যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন... এর মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে গেল। আমি আপনাকে ফলো করতে করতে পার্কে যাই, আর সুযোগ বুঝে ডায়েরিটা রেখে দিই, যাতে আপনার চোখে পড়ে। আমার মনে হচ্ছে কাকা খুন হয়েছেন। আর এর সমাধান একমাত্র আপনিই করতে পারবেন। - তোমার কাকিমার ধারণা তুমিই খুন করেছো। - আমি কেন খুন করবো বলুন? কাকার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী এমনিতেই তো আমি। তাহলে আমি শুধু শুধু কেন খুন করবো? - তা ঠিক। আচ্ছা, আমি একবার লাইব্রেরিটা দেখতে চাই। দেখানো যাবে? - হ্যাঁ, চলুন। আমি ডায়েরিটা নিয়ে লাইব্রেরিতে গেলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি সমাধানের দ্বারে পৌঁছে গেছি। আগের চেয়েও বেশি সুন্দর ও গোছানো স্যারের লাইব্রেরিটা। ওনার ইজিচেয়ারের পাশে একটা সিঙ্গেল চৌকি পাতা আছে। লাইব্রেরিতে চৌধুরী স্যারের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই আছে। এরকম বইপাগল লোক খুব কম দেখা যায়। - আচ্ছা, সেইরাতে তিনি কোন বইটা পড়ছিলেন? - এটা ঠিক বলতে পারবো না, তবে খাটের বালিশের কাছে একটা মোটা বই আছে, ওটা হতে পারে। ওখানেই আছে, কেউ হাত দেয়নি। Ralph Ellison এর "The Invisible Man" বইটাই পড়ছিলেন। বালিশের পাশে একমাত্র এই বইটাই আছে। বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়ল। হুমম, খুনি মনে হচ্ছে ভুল করে প্রমাণ ছেড়ে গেছে। আমি সাথে সাথে আমার এস পি বন্ধুকে ফোন করে বিষয়টা জানালাম। সিগারেট কেনার ছুতোয় বাড়ির বাইরে এসে ডায়েরি আর বইটা বন্ধুকে দেখালাম আর বইটা ল্যাবে পাঠাতে বললাম। এস পি বন্ধু আমাকে আধাঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেবে বলে আশ্বাস দিল। ফিরে এসে আমি ডায়েরিটা মন দিয়ে পড়তে লাগলাম। দু'সপ্তাহ আগে লেখা "এই শেষ বয়সে এইসব যন্ত্রণা ভালো লাগে না। আমার যা ইচ্ছা তাই করবো।" দশদিন আগে লেখা, "সুমন আমার প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নিচ্ছে। যা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।" একসপ্তাহ আগে লেখা, "আমি সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। এটাই ভালো।" এরপরের প্রতিদিন প্রায় একই লেখা...... এর থেকে বোঝা যায় যে উনি বহুদিন ধরেই অবসাদে ভুগছিলেন। রুমা চা নিয়ে এসেছে। আমি আর মিসেস চৌধুরী মুখোমুখি বসে আছি। একটু দূরে বসেছে সুমন। রুমা ঘামছে। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে লাগল। আমি চা শেষ করে সিগারেট ধরালাম। কিছু কথা আড়াল থেকে বলতে হয়। সিগারেটের ধোয়া একধরণের আড়াল তৈরি করে। মিসেস চৌধুরীর মুখে হালকা হাসির রেখা। এমনকি হোঁচট খেয়ে পড়ে পা মচকে ফেলেও হাসে। আমি বললাম, - একটা জিনিস কী জানেন? অতি বুদ্ধিমান লোকেও পুরোপুরি নিখুঁতভাবে অন্যায় করতে পারে না। কোন না কোন ভুল করবেই। চৌধুরী স্যারের খুনও খুব নিখুঁতভাবে হয়েছে। আর নিখুঁতভাবে ভুলও ধরা পড়েছে। ভাবতে পারেন! মিসেস চৌধুরী সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, - কে খুন করেছে? - বলবো। তার আগে বলি কিভাবে খুন হয়েছে। বিগত কয়েকমাস যাবৎ স্যার খুবই মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সবার থেকে দূরে দূরে থাকতে চাইছিলেন। সবটাই ওনার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। মিসেস চৌধুরী তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, - খুন কিভাবে হল জানতে পেরেছেন? - চৌধুরী স্যার রাত জেগে বই পড়েন এটা খুনির জানা। উনি যে বইটা পড়ছিলেন, সেই বইয়ের প্রতিটা পাতার কার্নিশে খুব মারাত্মক পটাশিয়াম সায়ানাইড দেওয়া হয়। বইয়ের পাতা উল্টানোর জন্য মুখের থুথু আঙ্গুলে লাগানো স্যারের অভ্যাস। এভাবেই স্যার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলেন আর একটু একটু করে বিষ খাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, এর সাথে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। রুমা খুব আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, - কে খুন করেছে স্যারকে? - মিসেস চৌধুরী। মিসেস চৌধুরী খুন করেছেন। মিসেস চৌধুরী একটুও চমকালেন না। - আমি কিভাবে বুঝলাম শুনবেন? আপনি অলিভ অয়েল ব্যবহার করেন। চৌধুরী স্যার অলিভ অয়েল ব্যবহার করেন না। আমি তার সব জামাকাপড় শুকে দেখেছি। বরং আপনার ঘর থেকে এই গন্ধ পেয়েছি। আপনি আশেপাশে থাকলে সেই গন্ধ পেয়েছি। আর আমি বই থেকেও অলিভ অয়েলের গন্ধ পেয়েছি। লাইব্রেরিতে সবাই চাইলেই যেতে পারে না, কিন্তু আপনি যেতেন। স্যারের চায়ের সাথে ঘুমের ওষুধ আপনিই মিশিয়ে ছিলেন। যে বইটা স্যার পড়ছিলেন সেই বইয়ের কভারে চায়ের দাগ পাওয়া যায়। রাতে বই পড়তে পড়তে চা খাওয়া স্যারের অভ্যাস। আর মিসেস চৌধুরী চা খান না, তা সবাই জানে। আরোও একটা প্রমাণ, আপনার পা মচকে যাওয়া। আপনার কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসার সময় দরজায় ধাক্কা খেয়ে আপনি পা টা মচকে ফেলেন। যদিও সবাই জানে ওটা বাথরুমে পড়ে গিয়ে হয়েছে। কিন্তু আপনার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল সব গন্ডগোল করে দিল। বাথরুমে পড়ে গিয়ে পা মোচকানো সম্ভব কিন্তু রক্তপাত কিছুটা আশ্চর্যজনক। দরজায় ধাক্কা লেগে বুড়ো আঙুলের নখের গোঁড়া গেল ভেঙে, ছিটেফোঁটা রক্ত বের হল, দরজার কাঠে তার দাগ আছে, আর সেটা যে আপনার তার প্রমাণ ক্র্যাপ ব্যান্ডেজের নীচে আপনার পায়ে লাগানো ব্যান্ডেড। ব্যাস, হিসাব মিলে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল। এখন খুনের উদ্দেশ্যটা কি বলবেন? কেন খুন করলেন? আর আপনি নিজে থেকেই বা কেন এই রহস্য উদ্ঘাটনের কাজ দিলেন? মিসেস চৌধুরীর চোখের দৃষ্টি টি-টেবিলে রাখা খালি চায়ের কাপের দিকে। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু সময় নিয়ে বলতে শুরু করলেন, - অভিষেকের আমাকে বিয়ে করার কারণ ছিল নিজের একাকীত্ব ঘোচানো। আমার কথা ভাবে নি। আমার একজের সাথে সম্পর্ক হয়। আমি অভিষেককে জানাই সবটা। কিন্তু ও মানতে চায়নি। আমাকে বলে ওর মৃত্যুর পর আমি আমার মতো চলতে পারবো, তার আগে নয়। তাই আমি প্ল্যান করি। বাকিটা তো আপনি আগেই বলে দিয়েছেন। কিন্তু আমার প্রেমিককে সব ঘটনা জানানোর পর আমাকে অস্বীকার করে। এবার বলুন আমি কি করবো? তাই আপনি আসাতে আমার কাজ সহজ হয়ে গেল। ঠিক করলাম সবাইকে সবটা জানাতে হবে। অন্যায় করেছি যখন তখন ... খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, - আমি ধারনা করেছিলাম সম্পত্তির জন্য খুন করেছেন। কিন্তু ... যাইহোক, পুলিশকে কি আপনি নিজেই সবটা বলবেন নাকি আমি...... - না, আমিই কনফেশ করবো। - আমি একটু স্বস্তি পেলাম। স্যার এবার শান্তি পাবেন। এতক্ষণ স্যার যেন "The Invisible Man" হয়ে আমাদের মাঝেই ছিলেন......
We have dedicated and hardworking people always ready to help.