বিসর্জন
টেবিলের উপর রাখা ফোন টা হঠাৎ বেজে উঠল। অদৃজা রান্না ঘরে ছিল, ও ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল-- “ তিথি তোর ফোন...”
তিথি: হ্যাঁ বলো (ফোন রিসিভ করে)
তিথির মা: কি রে কোথায় থাকিস বলতো? এতক্ষণ ধরে ফোন করেছি ধরছিলি না কেন?
তিথি: উফ্ মা! আমি exercise করছিলাম, রোজ তো এই সময়েই করি জানো না?
তিথির মা: আচ্ছা, আচ্ছা শোন তোর মামা ফোন করেছিল, এ বছর নাকি খুব ধুমধাম করে পুজো হবে, তুই কবে যাবি বলতো?
তিথি: মা! আবার??
এতক্ষণে অদৃজা বেরিয়ে এসেছে রান্নাঘর থেকে, হাতে ফ্রুট জুস, তিথি এই সময় খায়।
অদৃজা: কে রে? কাকিমা? আমায় দে না রে প্লিজ!
তিথি: হ্যাঁ, দাঁড়া। মা, অদৃজা তোমার সাথে কথা বলবে, নাও।
অদৃজা: হ্যালো, কাকিমা কেমন আছো?
তিথির মা: হ্যাঁ, রে ভালো আছি। তুই কেমন আছিস্?
অদৃজা: খুব ভালো।
তিথির মা: শোন না রে মা, তুই একটু তিথি কে বোঝা না রে, দেখ ওর মামা, মামি, দিদা সবাই কত করে বলছে ওকে ওখানে যাওয়ার জন্য, ও তো কিছুতেই শুনছে না।
অদৃজা: আচ্ছা কাকিমা, তুমি চিন্তা করো না। আমি ওকে ঠিক রাজি করাবো, এখন রাখি? তুমি সাবধানে থেকো।
অদৃজা: তিথি, তোর সাথে একটু কথা ছিল... বলছি...
তিথি: ব্যাস এবার তুইও শুরু করবি তো! দেখ অদৃ আমার ভালোলাগে না ওখানে যেতে, তুই তো জানিস্।
ওখানে চারিদিকে দাদুর স্মৃতি, আমার মন খারাপ করে।
জুসের গ্লাসটা টেবিলে রেখে খাটের উপর অদৃজার মুখোমুখি বসল তিথি।
আবার বলল, ছোটবেলা থেকে প্রতি বছর পুজোর সময় আমি মামাবাড়ি যেতাম। বিশ্বাস কর, সারাবছর অপেক্ষা করে থাকতাম। দাদুর সাথে পুজোর বাজার করা, একসাথে কাশফুল তোলা, মায়ের আগমনী গান শোনা, পুজোর কদিন খাওয়ার কি কি মেনু হবে সব আমরা একসাথে ঠিক করতাম। দাদু মারা যাওয়ার পর পুজোর আনন্দ টা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রে। ( তিথি মুখ নিচু করে বসে রইল)
অদৃজা: আমি বুঝতে পারছি তোর কষ্টটা, কিন্তু মানুষ তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না।
আর ওখানে তো তোর দিদা, মামা, মামি, দাদা, বোন সবাই আছে। সবাই তোকে কত ভালোবাসে বলতো?
কাকু, কাকিমাও তো যাচ্ছেন।
তিথি: (বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল) ঠিক আছে, আমি যাব। কিন্তু একটা শর্ত আছে, তুই ও যাবি আমার সাথে। বল রাজি?
অদৃজা: আমি?? আমি ওখানে গিয়ে কি করব?
তিথি: আরে? কি আবার করবি? পুজো হবে আমরা সবাই আনন্দ করব একসাথে। তোকে ছাড়া আমি কিন্তু যাব না।
অদৃজা: আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাব।
তিথি আর অদৃজা দুজনেই যাদবপুর থেকে ইংলিশে এম.এ করছে। একই রুমে থাকে। দুবছরে ওদের মধ্যে এত গাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে দুজন দুজন কে ছাড়া কোথাও যায় না।
অদৃজা জলপাইগুড়ির মেয়ে, এইচ্.এস এর পর যাদবপুরে ভর্তি হয়।
তিথির বাড়ি বাঁকুড়া।
তিথির মামাবাড়ি মেদিনীপুর থেকে ১০০ কিলোমিটার ভিতরে রাধামোহনপুর গ্রামে। সেখানে ওর দাদুর দাদু ছিলেন জমিদার। এখন যদিও সেরকম কিছুই নেই, তবে গ্রামের সবাই ওর দাদুকে খুব মান্য করত। প্রতি বছর খুব ঘটা করে পুজো হয়, পুজোর কদিন ওই বাড়িতে ভোজ বসে। ১৫০ বছরের পুরোনো পুজো।
তবে তিথির দাদু মারা যাওয়ার পর গত পাঁচ বছর আর সেরকম জাঁকজমক হয় না।
এবার যদিও মামারা খুব উদ্যোগ নিয়েছে।
তিথি: অদৃ তোর মন খারাপ করছে না তো?
অদৃজা: মন খারাপ করবে কেন?
তিথি: এই যে কলকাতার পুজো ছেড়ে কোন এক দূর গ্রামের পুজো দেখতে যাচ্ছিস...
আজ পঞ্চমী, চারিদিকে কতো আয়োজন, (আরও বলতে যাচ্ছিল তিথি, কিন্তু অদৃজা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল)
অদৃজা: তিথি, মজা করছিস আমার সাথে?
আরে কলকাতার পুজো তো দেখেছি ৪ বছর ধরে, সত্যি কথা বলতে বনেদি বাড়ির পুজো দেখার আমার অনেক দিনের শখ।
আর সারাবছর এই ব্যস্ত শহরকে দেখেছি, পুজোর সময় একটু নিরিবিলি ভালোই লাগবে। কি বল??
তিথি: হুম... তা ঠিক।
পুজোর সময় অদৃজা কেমন মনমরা হয়ে থাকে তিথি সেটা লক্ষ্য করেছে। পুজোর সাথে ওর কোনও একটা খারাপ স্মৃতি আছে, কিন্তু বলেনা কখনো। তিথি ও জোর করে না। তবে কোনো একটা আঘাত যে অদৃজার মনকে ছেয়ে আছে সেটা ও বুঝতে পারে।
গাড়ি চলছে, দুজনে কখনো রাস্তার দুধারের কাশফুল দেখছে, কখনো তিথি ওর মামাবাড়ির কথা বলছে অদৃজা কে।
দেখতে দেখতে সূর্য যখন প্রায় মাথার উপর তখন ওরা পৌঁছালো রাধামোহনপুরে।
গাড়ি থেকে নামতেই বাড়িতে হইচই পরে গেল। তিথির মা, বাবা সকালেই এসেছে। ওরা এসেছে শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এল। তিথি একে একে সবার সাথে অদৃজার পরিচয় করিয়ে দিল।
বড়মামা, মেজমামা, ছোটমামা, বড়মামার দুই ছেলে শাশত্ব, সাগ্নিক, দুজনেই তিথির থেকে বয়সে বড়। মেজমামার এক ছেলে তিথির প্রায় সমবয়সী নীলাভ, কলকাতায় থাকে, আর দুই মেয়ে- কনক আর দূর্বা, তিথির থেকে ছোট।
ছোটমামার একটাই মেয়ে বিথি। শাশত্বর বৌ চন্দ্রিমা। বৌদির সাথে তিথির খুব ভাব। আর ওদের মেয়ে মিঠু বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যা। সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবার।
সবার সাথে কথা বলে ওরা দিদার সাথে দেখা করতে গেল দিদার ঘরে।
দিদা: (কান মুলে দিয়ে তিথি কে বললেন) তুই কী রে? এই বুড়ি টার কথা একবারও মনে পরে না? দাদুই সব, আমি কেউ না? মরেই তো যাব একদিন, দেখতেও তো আসতে পারিস মাঝে মাঝে (বলেই কেঁদে ফেললেন)। তিথির চোখেও জল চলে এল।
তিথি: (দিদাকে জড়িয়ে ধরে বলল) এরকম বলছো এখন বলতো? এইতো আমি এসেছি দেখো পুজোই খুব মজা করব সবাই মিলে।
ও দিদা ও আমার বান্ধবী অদৃজা।
অদৃজা এতক্ষণ একটু দূরে দাড়িেয় ছিল এবার কাছে এল।
দিদা: বাঃ ভারী মিষ্টি মেয়ে।
দিদা: যা, অনেক বেলা হয়েছে, তোরা স্নান সেরে ঠাকুর দালানে যা।
ওরা দুজনে স্নান করে ঠাকুর দালানে গিয়ে উপস্থিত হল, সেখানে মায়ের দশ হাতে দশ রকমের অস্ত্র সাজানো হচ্ছে, বাড়ির অন্য সদস্য রাও আছে সেখানে।
তিথি: মেজমামি! নীলাভ আসেনি?
মেজমামি: ওর তো আজকেই আসার কথা। তোর সাথে কথা হয়নি?
তিথি: আমি ওকে কত বার বললাম আমরা একসঙ্গে আসব, কিন্তু তোমার ছেলে এত ব্যস্ত, তার কীসব কাজ আছে।
অদৃজা:আচ্ছা মাকে গহনা কখন পড়ানো হবে??
বড়মামি: সন্ধ্যা বেলায়।
মিঠু: অদৃজা পিপি চলো তোমাকে বাড়িটা ঘুরে দেখিয়ে আনি।
ছোটমামি: হ্যাঁ, সেই ভালো, তবে বেশি দেরি করো না।
তিথি: আচ্ছা মামি, আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসব। চল অদৃ।
আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, সন্ধ্যা বেলা মাকে গহনা পড়ানো হল।
বৌদি, কনক, দূর্বা, তিথি, অদৃজা, মিঠু সবাই একসাথে বসে কত গল্প, হইহই...
এই অল্প সময়ে বাড়ির সবার সাথে অদৃজা বেশ মিশে গেছে।
অদৃজার বাড়িতে বাবা আর মা, ওদের ছোট পরিবার।
এত বড় পরিবার, সবাই এত ভালো ওর মনটাই আনন্দে ভরে গেছে এখানে এসে।
এরকম পঞ্চমী প্রথম বার কাটালো সে।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল অদৃজার ঢাকের শব্দে। ফোন হাতে নিয়ে দেখল সাড়ে পাঁচটা বাজে। তিথি কে ডেকে বলল-
অদৃজা: এই তিথি ওঠ! আজ তো মায়ের বোধন হবে। কত কাজ! তাড়াতাড়ি ওঠ!
দুজনে ওঠে চটপট রেডি হয়ে ঠাকুর দালানে গেল, বাড়ির বড়রা সবাই আছে। পুজোর জোগাড় চলছে, ওরাও হাত লাগালো।
আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে লাগলো। গ্রামের লোকজন আসতে লাগলো। লুচি, আলুর দমে গন্ধে বাড়ি মম করছে।
মায়ের বোধনের পুজো শেষ হল, প্রসাদ বিতরণ চলছে এমন সময়-
দূর্বা: ওই তো! দাদা চলে এসেছে।
তোর এখন আসার সময় হল?
তিথি: তোর বাড়ির পুজো, আর তুই এখন আসছিস্?
নীলাভ: আর বলিস না, এই রণ টার জন্য। কিন্তু তুই বল তোর কী খবর? ৫ বছর পর মামাবাড়ির কথা মনে পড়ল?
তিথির মা: আচ্ছা সব কথা কি বাইরে দাঁড়িয়েই বলবি, আগে ভেতরে আয় মা কে প্রণাম কর। গল্প করার অনেক সময় আছে।
নীলাভ: হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কিন্তু এই রণ টা আবার কোথায় গেল?
রৌণক: এই তো, আছি আছি। আরে মা ফোন করেছিল তাই কথা বলছিলাম।
নীলাভ: আয়, আয়....
তিথি ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রণ মানে রৌণক। আমরা একসাথে এম. এস সি করছি, একই মেসে থাকি।
তিথি: ও আচ্ছা, তাহলে তোমার জন্য নীলাভর এত দেরি হল আসতে?
রৌণক: আসলে একটা কাজ পরে গিয়েছিল, কিন্তু খুব বেশি দেরি হয়নি।
অদৃজা সবাই কে প্রসাদ দিয়ে দুটো প্রসাদের প্লেট নিয়ে ওদের দিকে যাচ্ছিল, কিছুটা যাবার পর সে থমকে দাঁড়ালো, নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ঠিক দেখছে তো?
অদৃজার সারা শরীর কাঁপছে, রাগে, ভয়ে...
হাতের প্লেট দুটো আর একটু হলেই পরে যেত,
চন্দ্রিমা এসে প্লেট দুটো ধরল।
চন্দ্রিমা- তোমার কি শরীর খারাপ করছে অদৃজা?
অদৃজা: না, না সেরকম কিছু না।( অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল সে)
চন্দ্রিমা: দাও আমি দিয়ে আসছি।
চন্দ্রিমা প্লেট দুটো নিয়ে চলে যেতেই অদৃজা কাউকে কিছু না বলে ওখান থেকে বেড়িয়ে বাড়ির পিছন দিকে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে রইল চুপ করে।
এদিকে সবাই তখন রণ কে নিয়ে ব্যস্ত।।
পুরনো জমিদার বাড়ি, কড়িবরগার ছাদ, খড়খড়ির জানালা, লম্বা বারান্দা।
সেই বারান্দায় সবাই সারি দিয়ে খেতে বসেছে মধ্যাহ্নভোজ, এলাহি আয়োজন।
তিথি, অদৃজাকে একরকম জোর করেই নিয়ে এল।
তিথির মা: তোর কি কিছু হয়েছে অদৃজা?
তখন চন্দ্রিমা বলছিল।
অদৃজা: না, না কাকিমা, কিছু হয়নি।
তিথি: মা জানো, ও এখন ও বলছে খাবে না কিছু, আমি তো জোর করে ধরে আনলাম।
তিথির মা: ও মা! খাবি না কেন?
অদৃজা: না, আসলে...
দিদা: (এতক্ষণ চুপ করে ছিল এবার বলল) আমি কিন্তু কোনো কথা শুনবো না, চুপ করে বসে পর সবাই।
ওরাও বসে পরল।
রণ আর নীলাভ ও বসে খাচ্ছিল। অদৃজার গলার স্বর রণর ভীষণ পরিচিত, নাম শুনে সে ওত গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু এবার সে খাওয়া ফেলে তাকালো মেয়েটির দিকে।
খুব অবাক হল রণ।
সেই টানাটানা চোখ, ছিপছিপে চেহারা, কিন্তু মাধুর্য আছে, আর সেই মায়া ভরা মুখ। আগের থেকে একটু যেন বড় হয়েছে মেয়েটা, মনে মনে হাসলো রণ।
অদৃজার দিকে রৌণক তাকিয়ে আছে দেখে তিথি বলল
তিথি: ও রণ দা ও আমার বান্ধবী, অদৃজা।
অদৃজা! তোকে নীলাভর কথা বলেছিলাম, ও নীলাভ আর, ও রণদা, নীলাভর বেস্ট ফ্রেন্ড।
নীলাভ: Hi... তুমি অদৃজা! Nice to meet you. তিথির মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। খাওয়া শেষ করে জমিয়ে আড্ডা দেব।
অদৃজা: হুম।
খাওয়া শেষে সবাই বসল একসাথে শুধু অদৃজা মাথা ব্যথার নাম করে ঘরে চলে গেল। তার যে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
একা একা বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলো রৌণকের সাথে বন্ধুত্ব, একসাথে কাটানো মূহুর্ত, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা ওদের সম্পর্ক....
এসব ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে ওর।
কলেজের 1st year এ এই রকম ষষ্ঠীর দিনেই রণ অদৃজা কে প্রপোজ করেছিল।
সন্ধ্যা বেলা পুজোর সময় তিথি লক্ষ্য করল অদৃজা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে।
রাতে সবাই যখন শুয়ে পড়েছে তখন তিথি অদৃজা কে জিজ্ঞাসা করল ওর কি হয়েছে?
অদৃজা কেমন বাচ্চাদের মতো তিথি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তিথি একরকম ছেদ ধরে বসল, ও সব শুনতে চায়। অদৃজা বলতে শুরু করল রণ আর ওর সম্পর্কের কথা। সব শুনে তিথি বলল বলল তাহলে কি এমন ঘটেছিল যে তোরা আলাদা হয়ে গেলি?
এদিকে রণ ও খুব চুপচাপ হয়ে আছে, সেটা দেখে নীলাভ বলল
নীলাভ: তুই কার কথা ভেবে মন খারাপ করে আছিস?
তনুজা?
রৌণক: ধুর! না, না।
চল ঘুমিয়ে পরি, কাল তোদের গ্রাম টা একটু ঘুরে দেখব।
চারিদিকে লাল, আকাশে, বাতাসে ছড়িয়ে পরেছে। সবাই সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে...
রণ সবার চোখের আড়ালে অদৃকে টেনে নিল নিজের কাছে, রাঙিয়ে দিল ওর গাল দুটো... আলতো করে চুম্বন এঁকে দিল ওর কপালে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল অদৃজা, ওর হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেছে। হঠাত্ ওর হাত ছেড়ে রণ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে ভীড়ের মধ্যে। অদৃজা ডাকতে চাইছে কিন্তু পারছে না। এবার শুনতে পেল তিথি ওকে ডাকছে।
লাফিয়ে ওঠে বসল অদৃজা বিছানার উপর...
অদৃজা: রণ! এই রণ, প্লিজ যাস না।
তিথি: কী বলছিস্ তুই? রণ? ও এখানে কেন আসবে? এই অদৃ? কী হল? কথা বল...
অদৃজা: ( এবার আস্তে, আস্তে ঘোর কাটল, বুঝতে পারলো ও স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ)
হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, মানে.....
তিথি: আবার কী হ্যাঁ, না করছিস? তুই কি স্বপ্ন দেখছিলিস?
অদৃজা চুপ করে বসে রইল, ফার্স্ট ইয়ারের দশমীর দিনটা ওরা যেভাবে কাটিয়েছিল, সেটাই ও স্বপ্ন দেখছিল।
তিথি: আরে আবার কি ভাবছিস?
দেখ আমি বুঝতে পারছি, রণদা কে তুই কতটা ভালোবাসতিস, এখনো বাসিস, কিন্তু কি আর করা যাবে যাবে বল? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, প্লিজ পুজোর দিনে মন খারাপ করিস না, আজ সপ্তমী, কিরে? পুজোর ওখানে যাবিনা?
অদৃজা: হ্যাঁ যাবো, চল।
দুজনে ঠাকুরদালানে যাচ্ছিল, হঠাৎ রণর সাথে দেখা হল।
রণ: তোমরা ঠাকুরদালানে যাচ্ছ?
তিথি: হ্যাঁ, তুমিও যাচ্ছ?
রণ: আরে আমি নীলাভকে খুঁজছি। কোথায় যে গেল?
তিথি ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পেরে বলল—
তিথি: রণদা তুমি চলে যাবে কেন? আজ তো সবে সপ্তমী, বাড়ির সবাই জানলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবে। না,না তোমার যাওয়া হবেনা।
(অদ্রিজা মুখে না বললেও ও যে চায় রণ থাকুক, সেটা তিথি বুঝতে পারছে, হাজার হোক মান অভিমান, তবুও ভালোবাসায় পিছুটান থেকেই যায়)
রণ: আর বলোনা! একটা আর্জেন্ট কাজ এসে পড়েছে, আমাকে যেতেই হবে।
তিথি: না! তোমার পুজোর মধ্যেও কি কাজ শুনি? আর তাছাড়া এ বাড়ির একটা নিয়ম আছে, মা যতদিন এ বাড়িতে থাকবেন, কেউ এখান থেকে কোথাও যেতে পারবেনা।
তিথি: ওকে আজ আর খুঁজে পাবেনা, দেখো ওর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কোথায় গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
অদৃজা : আমি গেলাম, তোরা আয়।
রণ বুঝতে পারছে অদৃজা ওর জন্য কাল থেকে আফ্সেট, মজাও করতে পারছে না ঠিকমত, এত মিশুকে মেয়েটা চুপচাপ, একা হয়ে গেছে কেমন।
অদৃজা কে শুনিয়েই রণ বলল—
রণ: না আসলে আমাকে আজকে ফিরে যেতে হবে।
কথাটা শুনে অদৃজা দাঁড়িয়ে পড়ল, স্বপ্নের কথা মনে পড়ল ওর, ওকে ছেড়ে চলে যেতে চায় রণ, কেনই বা থাকবে? অদৃজার মত আনস্মার্ট মেয়েকে কি কারোর ভালো লাগতে পারে?
কিন্তু ওর যে মন চাইছে রণ থাকুক, কতদিন পরে আবার দেখছে ওকে, রাগ হচ্ছে, কিন্তু চলে যাবে শুনে কষ্ট ও হচ্ছে।
রণ: ধুর! এরকম আবার হয় নাকি ?
তিথি: হয়, হয়, বিশ্বাস না হলে তুমি বড়দের জিজ্ঞেস করো।
এতক্ষণে নীলাভ চলে এসেছে, অদৃজা একটু দাঁড়িয়েই ঠাকুরদালানে চলে গেছে।
নীলাভ: তোরা এখানে কি করছিস? ঠাকুরদালানে চল, অঞ্জলি দিবি না?
তিথি: দেখ ,তোর বন্ধু বলছে চলে যাবে।
নীলাভ:কি? আজ? তোর কি মার খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে?
রণ দেখল এখান থেকে বেরোনোর কোন উপায়ই নেই, অগত্যা ঠাকুরদালানে গেল।
পুজো শেষে নীলাভ,রণ, তিথি, অদ্রিজা, কণক, দূর্বা, সবাই একসাথে ঘুরতে বেরোলো, এবার অদৃজা নিজের ইচ্ছাতেই গেল।
তিথিও এটাই চাইছিল, ও সুযোগ বুঝে
ওদের দুজনকে সামনাসামনি আনবে। নীলাভর কাছ থেকে খবর জোগাড় করেছে রণ সিঙ্গেল। যদিও নীলাভ একটু বুঝতে ভুল করেছিল তিথির question এ কিন্তু তিথি ঠিক করে নিয়েছে দুজনে যখন সিঙ্গেল তখন ডাল মে কুচ কালা হে হি।
সবাই একসাথে ঘুরছে, কনক, দূর্বা, নীলাভ ওদের গ্রামের কথা বলছে বাকিদের, তিথিও বলছে কিছু কিছু। কিছুদুর যাওয়ার পর তিথি এরকম বাহানা করে কনক-দুর্গা কে পাঠিয়ে দিল ওর এক বান্ধবীর বাড়ি, কি কি বলতে হবে তাও বলে দিল।
তিথির ছোট বেলার খেলার সাথী ছিল সে, মামাবাড়ি এলেই ওর সাথে খেলা করত। ওর মামাবাড়ি থেকে বেশি দূরে বাড়ি নয়, এবার এসে আর দেখা করা হয়নি।
কনক-দুর্গা চলে যাবার পর তিথি নীলাভকে উদ্দেশ্য করে বলল-
তিথি: নীলাভ কি রে, মেজো মাসি যে ফর্দ দিয়েছে এনেছিস?
নীলাভ: হ্যাঁ, কেন?
তিথি: তাহলে চল আমরা বাজার টা সেরে ফেলি,
নীলাভ: হ্যাঁ কিন্তু দুটো বাইক হলে ভালো হতো।
এত বাজার হেঁটে করা, তারপর বাড়ি নিয়ে যাওয়া চাপের হবে।
তিথি: তোর বন্ধুদের কারোর বাইক একটু সময় ধার নিয়ে নে।
নীলাভ: আছে একটা,
তিথি: ওইতো, তাহলে তো হয়েই গেল।
নীলাভ: আরে আমরা চারজন আর একটা বাইক কি যে বলিস না?
তিথি এবার ডাইরেক্ট বলেই দিল...
তিথি: আরে আমরা যাই বাজার করে আনি কনক, দুর্গা এলে ওদের নিয়ে গ্রামটা ঘুরে দেখাবে, ততক্ষণ ওরা একটু ওয়েট করুক।
ওর প্রস্তাবে সবাই কেমন হতভম্ব হয়ে গেল।
অদৃজা এতক্ষণ চুপ করে ছিল এবার বলল..
অদৃজা: খুব বেশিদূর এগোয়নি আমরা আমি এখান থেকে ফিরে যেতে পারবো,
তোরা যা আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
তিথি: অদৃ তা বললে হয় নাকি?সবাই একসাথে বেরিয়েছি, একসাথেই ফিরব। আসলে এখানে বাজার টা একটু দূরে হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসতে অনেক দেরি হবে।
রণ: তাহলে চলো আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি নীল বরং (অদৃজা কে দেখিয়ে) ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাক।
তিথি: আসলে পাঁচ বছর পর এলাম তো রাস্তা গুলিয়ে যাবে।
ইচ্ছা না থাকা সত্বেও তিথির প্রস্তাব সবাইকে মেনে নিতে হলো।
রণ একটা গাছের তলায় গিয়ে বসল, অদৃজা একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল, আর ভাবতে লাগলো (কনক আর দূর্বা কখন যে আসবে)।
রণ: বলছি এখানে এসে বসলে কি খুব প্রবলেম হবে? আমি না হয় উঠে যাচ্ছি।
অদৃজা চুপ।
রণ: সকালে তো চলে যেতেই চাইলাম, কি করব এরা কেউ শুনছে না।
অদৃজা তাও চুপ করে রইল।
রণ: (আবার বলল) তুমি চাইলে আমি চলে যেতে পারি, আমার জন্য তোমার অসুবিধা হচ্ছে।
অদৃজা (এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না)
তার দরকার নেই, আমার অসুবিধা হচ্ছে না।
আবার সব চুপচাপ।
রণ: কেমন আছো তুমি?
অদৃজা: ভালো।
এরমধ্যে কনক আর দূর্বা চলে এলো।
ওরা গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে শুরু করলো। রণ মাঝে মাঝে অদৃজার দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু অদৃজা নিজের মনে হাঁটছে, কনক আর দুর্বার সাথে কথা বলছে।
অদৃজা কে স্বাভাবিক দেখে রণ কিছুটা স্বস্তি পেল।
আজ বিকেল বেলা যখন আবার সবাই আড্ডা দিতে বসল, অদৃজা ছিল সেখানে। সবাই মিলে খুব মজা করলো। অদৃজা কে হাসতে দেখে রণর খুব আনন্দ হল।
কাল থেকে ওর নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল।
রৌণকের আদি বাড়ি ও জলপাইগুড়ি। বলতে গেলে ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে দুজনে, ক্লাস ১০, ১২ একসাথে পাশ করে। দুজন দুজনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। অদৃজা Arc এর স্টুডেন্ট, আর রণ ছিল Science এর।
যাদবপুরে রণ কেমিস্ট্রি আর অদৃজা ইংরাজি নিয়ে ভর্তি হল।
রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল রণ, অদৃজা সিরি দিয়ে উঠে বাঁদিকে যাচ্ছিল ওদের ঘরের দিকে, আবার দুজন মুখোমুখি। চোখে চোখ পরে গেল দুজনের।
রণ সিগারেট টা হাত থেকে ফেলে দিল।
অদৃজা কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে গেল।
ষষ্ঠী তে প্রোপোজ করার পর অদৃজা হ্যাঁ বলে দেয়।
পুজোতে ওদের প্রেম টা জমে উঠেছিল। কিন্তু কে জানতো এভাবে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে?
তিথি: কেমন বুদ্ধি করে তোদের দেখা করালাম বল!! অদৃজা: তুই পাগল? সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, It's Over....
কেন করছিস, এগুলো?
তিথি: কে বলল সব শেষ হয়ে গেছে? যদি সত্যি তাই হত, তাহলে তুই আর রণদা দুজনেই এখনও Single কেন? তোদের Break up তো 3 বছর আগে হয়ে গেছে।
অদৃজা: রণ... Single? (হেসে ফেলল অদৃজা)
সকাল বেলা তিথি র মা ওদের ঘরে এল। হাতে একটা প্যাকেট। সেটা অদৃজার হাতে দিয়ে বলল--
“ আজ তো অষ্টমী, আজকে এটা পড়বি তুই। তোরা তৈরি হয়ে আয়, আমি নীচে যায়, অনেক কাজ আছে।
অদৃজা: আচ্ছা কাকিমা।
তিথির মা চলে যাওয়ার পর তিথি বলল-
তিথি: খুলে দেখ কী আছে ওই প্যাকেটে।
অদৃজা প্যাকেট খুলে দেখল একটা শাড়ি, চওড়া লাল পাড়, আর সাদা সুতোর কাজ করা।
তিথি: (খুব Excited হয়ে বলল) কীরে পছন্দ তো??
অদৃজা: হ্যাঁ, খুব সুন্দর।
অদৃজা মনে মনে ভাবল, তার সাথে এরকম কেন হচ্ছে, বার বার অতীত তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।
2nd year exam এর মাস খানেক আগের ঘটনা, অদৃজা বুঝতে পারছে, রণ কেমন যেন পালটে গেছে। কিছুদিন আগেও অদৃজা কে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে রেস্টুরেন্টে ডিনার, মুভি...
অদৃজার এসব খুব একটা পছন্দ হত না, কিন্তু ও রণ কে না বলতে পারত না।
খুব সাধারণ মেয়ে অদৃজা, ও ভালোবাসে সকাল বেলা শিশির ভেজা ঘাসের উপর হাঁটতে। নিস্তব্ধ লাইব্রেরি তে সময় কাটাতে, আর পড়ন্ত সূর্যের লাল আভা যখন গঙ্গার জলে এসে পরবে তার সৌন্দর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করতে...
রণর হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই সে, একসাথে রবিঠাকুর কে চিনতে চাই।
এগুলো অবশ্য রণর কাছে খুব বোরিং।
বেশির ভাগ দিন কলেজ থেকে একসাথে বেরোত দুজনে, এক্সট্রা ক্লাস না থাকলে।
কিন্তু আজকাল রণ প্রায়ই এক্সট্রা ক্লাসের নাম করে কলেজ থেকে লেট করে বেরোত। অদৃজা কে একাই ফিরতে হত।
রণ আজকাল আর সেভাবে ফোন করত না অদৃজা কে।
একদিন কলেজে গিয়ে রণ কে খুঁজে না পেয়ে ওকে ফোন করল অদৃজা, Not reachable পেয়ে ও একটু টেনশনে পরে গেল। ও রণর বন্ধু দের কাছে খোঁজ নিয়েও সেরকম কিছু জানতে পারল না। ক্লাসে মন বসল না, রুমে গিয়ে রণ কে ফোন করল আবার, বেশ কয়েক বার ফোন করার পরে রণ ফোন রিসিভ করল।
অদৃজা: রণ! কোথায় আছো তুমি? আমার খুব টেনশন হচ্ছিল। কলেজে তোমায় খুঁজে না পেয়ে, তোমার বন্ধু দের কাছে খোঁজ করলাম, ওরাও কিছু বলতে পারল না। ফোন টাও.....
অদৃজা কে থামিয়ে রণ বলল-
রণ: উফ্! তোমার সব কিছু তে এত quarry কিসের? তুমি এমন ভাবে বলছো যেন আমার বিয়ে করা বৌ। আর কি বললে? টেনশন?
Come on অদৃ, আমরা আর ছোট নেয়, so.... pls...
অদৃজা আর কিছু বলতে পারল না, চুপ করে রইল।
রণ: শোনো, আমার একটা Important কাজ ছিল, আর তোমার tension হচ্ছে বলে, অযথা আমাকে ফোন করে Disturb করবে না।
ফোন কেটে দিল রণ।
অদৃজা এবার কেঁদে ফেলল, রণ এভাবে কোনোদিন এভাবে কথা বলেনি ওর সাথে। তাহলে রণ কি কোন কারণে রাগ করে আছে? পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে ফোন করবে হয়ত।
অদৃজা, রণ দুজনের বাড়িতেই ওদের বন্ধুত্বের কথা জানত। ওরা একই কলেজে পড়ে, সুবিধা, অসুবিধা হলে দুজন দুজনকে সাহায্য করতে পারবে এটা ভেবে অদৃজার মা, বাবা একটু নিশ্চিত হত। কিন্তু রণ যে অদৃজা কে এড়িয়ে চলছে সে কথা ও বাড়িতে জানাতে পারল না, ওরা চিন্তা করবে। অদৃজার সেরকম কোনও বন্ধু, বান্ধবী ও ছিল না। কলেজের, ওর রুমের বাকি মেয়েদের থেকে ও যে আলাদা, unsmart, ওদের মতো Modern নয়।
রণর Classmate মিলি ছিল অদৃজার একমাত্র ভালো বান্ধবী, অদৃজা ওকে সব কথা খুলে বলল।
মিলি: (প্রথমেই অদৃজা কে বলল) দেখ অদৃজা তোকে শক্ত হতে হবে।
অদৃজা: মানে? তুই এরকম কেন বলছিস?
মিলি: আমাদের Classmate তনুজা কে চিনিস তো?
অদৃজা: ওই তো, খুব সুন্দর দেখতে, খুব মর্ডান, নিজের গাড়ি নিয়ে কলেজে আসে, তাই তো?
মিলি: হ্যাঁ, হ্যাঁ ওর কথায় বলছি।
গত ৩ মাস ধরে দেখছি, ও আর রণর মধ্যে একটা relation তৈরি হয়েছে, প্রায়ই ওরা, ক্লাস না করে ঘুরতে যায়।
অদৃজা: রণ খুব মিশুকে, ওর মতো ছেলেই হয় না।
মিলি: ওরে তোর মাথায় কি একটু ও বুদ্ধি নেই?
ওরা দুজনে প্রেম করছে, রণ চিট করছে তোকে। অদৃজার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরল।
অদৃজা: (বির বির করতে করতে) না! রণ আমাকে চিট করতে পারে না, পারে না,... রণ... আমাকে চিট করতে...
মিলি: কি বলছিস বির বির করে?
অদৃজা: হ্যাঁ!
মিলি: তুই এসব কি বলছিস?
চোখ ছলছল করছে অদৃজার।
তিথি: তুই এখনও রেডি হোসনি কেন? অষ্টমীর পূজা শুরু হয়ে গেছে...
অদৃজা: এই তো এখনই হচ্ছি।
খুব অল্প সাজে, অদৃজা কে খুব সুন্দর দেখতে লাগছে। চওড়া লাল পাড় শাড়ি, লাল ব্লাউজ, কানে একটা দুল, কপালে ছোট একটা টিপ আর খোলা চুল।।
চন্দ্রিমা: (অদৃজা কে তিথির দিদার সামনে নিয়ে গিয়ে) ঠাম্মা! দেখো দেখো...
দিদা: ভারী মিষ্টি লাগছে, কারো নজর না লেগে যায়।
সবাই তো কদিনে অদৃজাকে ওই বাড়ির মেয়ের মতো আপন করে নিয়েছে।
রণ ও ছিল সবার মাঝে, অদৃজা কে দেখে চোখ ফেরাতে পারছিল না। কি মিষ্টি দেখাচ্ছে, ও এক দৃষ্টি তে চেয়ে রইল।
“ওঁ সর্বমঙ্গল্ল মঙ্গল্লে, শিবে সর্বাধ্য সাধিকে, শরন্ন্যে স্ত্রমবকে গৌরি নারায়ণী নমহঃস্তুতে।”
অষ্টমীর অঞ্জলি সম্পন্ন হল, কিছুক্ষণ পর সন্ধিপুজা হবে।
রণর খুব ইচ্ছে করছিল, অদৃজার সাথে একবার কথা বলতে, কিন্তু বাড়ি ভর্তি লোক। তিথি, অদৃজা, কনক, সবাই ছিল সেখানে, সন্ধিপুজার আয়োজন চলছে.... নীল ও আছে।
রণ: ( ঠিক কি বলবে বুঝতে পারল না, কিন্তু গিয়ে একটু আমতা, আমতা করেই বলল) ইয়ে... মানে... বলছি...
তিথি: হ্যাঁ, হ্যাঁ বলো...
কিছু লাগবে?
রণ: না... বলছি.... সন্ধিপুজা, কখন শুরু হবে?
তিথির মা: এই তো, আর কিছুক্ষণ পরেই।
কথা বলতে বলতে আড় চোখে অদৃজা কে দেখছিল রণ।
এবার অদৃজার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল।
আজ যেন নতুন করে ও প্রেমে পড়েছে ও অদৃজার।
পুজোর জোগার করতে করতে বড়মামি বলল-“যঞ্জের কাঠ আনা হয়নি, মায়ের ঘরে রাখা আছে। তিথি! কাওকে সাথে নিয়ে, নিয়ে আয় তো, ভারী আছে।”
অদৃজা: ( নিজেই বলল) আমি নিয়ে আসব মামি?
মামি: হ্যাঁ, যা, ঘরে আলমারির পাশে রাখা আছে, একা আনতে পারবি না।
অদৃজা: আমি পারব, নিয়ে আসছি।
অদৃজা ঠাকুর দালান থেকে বেড়িয়ে... দিদার ঘরের দিকে গেল।
রণ একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, অদৃজার পিছনে গেল। অদৃজা দিদার ঘর থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে বেরোল, অদৃজার একটু অসুবিধা হচ্ছিল, বেশ ভারী।
রণ এগিয়ে এসে ব্যাগ টা নিয়ে বলল-
“আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
দুজন আবার ঠাকুর দালানের দিকে যাচ্ছিল, রণ দাঁড়িয়ে পরল-
রণ: অদৃজা! একটু দাঁড়াবে?
ভারী ব্যাগ টা নিতে রণর হয়ত অসুবিধা হচ্ছে ভেবে অদৃজা দাঁড়িয়ে পরল। রণর কাজ করার যে অভ্যেস নেই, সেটা অদৃজার থেকে ভালো আর কে জানে?
অদৃজা: ব্যাগ আমি নিচ্ছি, ( রণর হাত থেকে ব্যাগ টা নিতে গেল)
রণ: (ব্যাগ দিল না, অদৃজার হাত ধরে বলল) তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে।
অদৃজা: হাত ছাড়ো, ঠাকুর দালানে সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
দেখতে দেখতে সন্ধিপুজা ও সমাপ্ত হল।
সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা, নাচ, গান, চললো সারা সন্ধ্যা ধরে।
রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, অদৃজা একা দাঁড়িয়ে আছে ঝুল বারান্দায়, রণর চোখেও ঘুম নেই।
অদৃজার পাশে এসে দাঁড়াল।
রণ: মিলি তোমায় মিথ্যে কথা বলেছিল সেদিন।
অদৃজা: আমি তোমায় বিশ্বাস করি না।
রণ: হুম, (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল)
রণ: কিন্তু আমি তোকে আজ সব বলতে চাই।
রণ বলতে শুরু করল-
বাবার শরীর তখন খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না, ঠিকমত কাজ করতেও পারত না। আমি দেখলাম, আমার খরচ যদি আমি চালাতে পারি, তাহলে একটু সুবিধা হবে।
কিন্তু কী করে করব? কে কাজ দেবে আমায়? কাজ খুঁজে বেরাচ্ছিলাম পার্টটাইম কিছু, কিন্তু পাচ্ছিলাম না।
তনুজা খুব ভালো মেয়ে, আমার খুব ভালো বন্ধু, শুধু বন্ধু। ও আমার সমস্যার কথা শুনে, ওর বাবাকে বলে একটা পার্টটাইম যবের ব্যবস্থা করে দেয়, শুধু একটা শর্ত দেয়, ওকে পড়াতে হবে, আর এই কথাগুলো আমি কাওকে বলতে পারব না।
তাই তোকে কিছু বলতে পারিনি, আর আমি জানতাম তুই জানতে পারলে আমায় কিছুতেই কাজ করতে দিবি না, আমার পড়ার ক্ষতি হবে এই ভেবে।
এতক্ষণ বলে রণ থামলো।
সব চুপচাপ...
অদৃজা: কাকু কেমন আছেন এখন?
রণ: নেই...
তুই আমায় ছেড়ে যাওয়ার পর, বাবাও.......
অনেক রাত হয়েছে, গুড নাইট।
রণ ঘরে চলে গেল।
অদৃজা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল...
সারারাত ঘুমাতে পারেনি অদৃজা, রণর বলা কথা গুলো ভেবেছে আর, নিজের অজান্তে শুধু কেঁদেছে।
এতটা ভুল বুঝল ও রণ কে, শুধু একজনের কথায়? আরও নানা প্রশ্ন ওর মন কে নাড়া দিতে থাকে। ভিতর ভিতর খুব ছটফট করতে থাকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, তিথি অদৃজা কে ঘরে খুঁজে না পেয়ে ফোন করে, কিন্তু ফোন ঘরেই আছে। তিথি বাইরে বেড়িয়ে দেখে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নীলাভ।
তিথি: তুই অদৃজা কে দেখেছিস?
নীলাভ: কয়? না তো! দেখ হয়তো ঠাকুর দালানে আছে।
তিথি ঠাকুর দালানে গিয়ে দেখল, কিন্ত অদৃজা সেখানেও নেই। এবার একটু অবাক হল তিথি। এত সকালে কোথায় গেল অদৃজা?
রণ: তোর কী হল? এরকম পাগলামি করছিস কেন? একা একা, কাওকে না বলে, এভাবে কেউ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে?
অদৃজা: তুমি আগে আমাকে সবটা কেন জানালে না?
রণ: তুই তো নিজেই বলেছিলি, আমি যেন তোর সামনে আর কখনও না আসি।
অদৃজা: ওটা তো রাগের মাথায় বলেছিলাম, সেটাও বোঝোনি?
রণ: বুঝেছি, ভেবেছিলাম তোকে ফোন করে বুঝিয়ে বলব সব কিছু। তুই তো ফোন নাম্বার ও চেঞ্জ করে ফেলেছিলি। এত অভিমান আমার উপর?
অদৃজা চুপ করে রইল।
রণ: তুই আমাকে এত দিনেও চিনতে পারলি না।
অদৃজা: আমি তো শহরের মেয়েদের মতো স্মার্ট নয়, ওদের মতো পোশাক পড়ি না, ক্লাবে যায়না, পার্টি করি না, এগুলো তো তোমার ভালোলাগে। অদৃজা কেঁদে ফেলল।
রণ: আবার কাঁদছিস? দেখ এবার আমি কিন্তু চলে যাব এখান থেকে।
অদৃজা: না, রণ প্লিজ... প্লিজ....
রণ: আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আর কান্নাকাটি নয়।
ভুল কিছু টা আমি ও করেছি রে, আসলে বন্ধুদের পাল্লায় পরে, আমি ও! কিন্তু তুই আমার সব কিছু পাগলি।
তিথি: তোরা এখানে? অদৃ? কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? রণ দা তুমি অন্তত বলো কী হয়েছে?
রণ: তিথি! তুমি হয়ত জানো না, আমরা দুজন দুজনকে...
তিথি: জানি, রণ দা। অদৃজা আমাকে বলেছে, সব কিছু।
কিন্তু তোমরা এখন চলো, বাড়ির সবাই উঠে পড়ছে, তোমাদের খোঁজ করবে, বিশেষ করে অদৃজার...
রণ: হ্যাঁ, চল। কিন্তু তোমার এই বান্ধবীর কান্না থামছে না যে! এবার মনে হয়, বন্যা হয়ে যাবে।
অদৃজা: রণ... দাঁড়াও তোমার হচ্ছে...
তিথি ও হেসে ফেলল
তিথি: আচ্ছা, বাকি কথা পরে হবে... এখন চল... অদৃ
আজ নবমী, বাড়িতে সবাই মিলে হইচই... কত আনন্দ...
কিন্তু অদৃজার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে...
রণর কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত ও শান্তি পাচ্ছে না। কিন্তু সবার মাঝে ও আলাদা করে রণর সাথে কথা বলবে কী করে?
নবমীর পুজোর শেষে সবার একটু মন খারাপ হল, কাল যে দশমী, মায়ের বিসর্জন...
বিকেলবেলায় বাড়ির প্রায় সবাই মিলে গোল হয়ে বসল... আড্ডা, গল্প, খেলা... আরও কত কি...
রণ খেয়াল করল অদৃজা একটু মনমরা হয়ে আছে।
রাতে কিছু না খেয়েই শুতে চলে গেল অদৃজা।
সবার খাওয়া হলে রণ তিথি কে বলল- অদৃজার খাবার বেড়ে দিতে।
রণ: আমি কী তোমাদের ঘরে একটু যেতে পারি?
তিথি: কেন পারবে না? চলো...
অদৃজা! দেখ, কে এসেছে!
রণর হাতে একটা প্লেটে খাবার সাজানো। অদৃজা বিছানায় শুয়ে ছিল...
উঠে বসল। রণ গিয়ে ওর পাশে বসল।
তিথি: তোমরা প্রেম কর, আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি (মুচকি হেসে তিথি চলে গেল)।
রণ: না খেয়ে চলে এলে যে...
অদৃজা: খেতে ইচ্ছে করছে না। রণ! আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি, প্লিজ.... আমায় ক্ষমা করে দাও...প্লিজ... (চোখ ছলছল করছে অদৃজার)
রণ: করতে পারি একটা শর্তে... আগে লক্ষী মেয়ের মতো খাবার টা খেয়ে নিতে হবে। নাও...
অদৃজা কিছু না বলে খেয়ে নিল।
অদৃজা যখনই মন খারাপ করে না খেয়ে থাকত, রণ নিজের হাতে ওকে খাইয়ে দিত, আজও তাই করল।
দুজনের মধ্যে দূরত্ব একটু একটু করে মিটতে লাগল....
দশমীর ডাকের আওয়াজ শুনলে.... মন কেমন ভার হয়ে যায়....
আবার একবছরের অপেক্ষা...
সকাল থেকে সবাই ব্যস্ত...
মাকে বরণ করার প্রস্তুতি চলছে।
অদৃজা: এ কদিন খুব আনন্দ হল বল?
তিথি: হ্যাঁ, কিন্তু মা আজ চলে যাবেন।
অদৃজা: হুম...
তিথি: রণ দা কোথায়? দেখছি না তো!
অদৃজা: জানিনা!
তিথি: তোদের মান- অভিমানের পালা এখনো শেষ হয়নি?
অদৃজা: ভুল বুঝে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ওকে...
দশমীর পূজা শেষ হল...
একে একে মাকে বরণ করতে শুরু করলেন বাড়ির মহিলারা, শুধু বাড়ির নয়, গ্রামের মহিলারাও এসেছেন, মা কে বরণ করতে।
অন্যদিকে চলছে ধুনুচি নাচ....
বরণ শেষে সবাই মাকে প্রণাম করে, মনের ইচ্ছে জানালো মাকে....
তারপর শুরু হল সিঁদুর খেলা...
তিথি, অদৃজা ওরাও সবার সাথে যোগ দিল।
এবার এল সেই সময়- মায়ের বিদায়ের পালা...
আয়োজনে সবাই ব্যস্ত....
তিথি অদৃজা কে ডেকে নিয়ে গেল...
অদৃজা: কোথায় যাচ্ছি আমরা?
তিথি: চল না....
তিথি ছাদে নিয়ে গেল অদৃজা কে...
রণ সেখানে উপস্থিত ছিল...
রণ: Thanks তিথি।
তিথি: আমার ট্রিট এর কথা মনে থাকবে তো?
রণ: থাকবে, থাকবে...
অদৃজা! তোর সাথে কিছু কথা ছিল....
অদৃজা: কি?
তিথি: আমি নিচে গেলাম, তোমরা বেশি দেরি করো না।
রণ: তুমি এখানে থাকতে পারো, আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।
তিথি: আমার নীচে কিছু কাজ আছে, আর সবাই খুঁজবে আমাকে।
তিথি চলে গেল।
অদৃজা: বলো কী বলবে?
রণ: আমাদের মধ্যে যাই ঘটে থাকুক, আমি আজও জানি, তুই আমার Best Friend, আজও তোকে আগের মতোই খুব ভালোবাসি, বা হয়ত তার থেকেও বেশি। জানিনা আবার কবে দেখা হবে? ভালো থাকিস্। আর কখনও কোনো প্রয়োজন হলে বলিস, আমি সব সময় তোর পাশে আছি।
অদৃজা: আমি বলেছিলাম, তুমি কখনো আমার সামনে আসবে না, তাই এতো অভিমান?
রণ: না রে! আমার জীবন এখন অনেক বদলে গেছে, আর এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে তোকে জড়াতে চাই না।
অদৃজা: আমি চাই।
আমি চাই, তুমি সব সময় আমার সামনে থাকো, ঠিক আগের মতোই।
আজও তোমায় খুব ভালবাসি... বলেই অদৃজা জড়িয়ে ধরল রণকে।
আবার বলল- আচ্ছা! আমাদের যত রাগ, অভিমান, আমরা আজ মায়ের পায়ে বিসর্জন দিতে পারিনা?
রণ এবার অদৃজা কে আরও কাছে টেনে বলল- “পারি”।
Author
Sumana Adhikary
Type
Emotional Story
Date
June 23, 2021